প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য চেষ্টা করতে হয়। চেষ্টা-সাধনা ছাড়া কোন কিছু অর্জন করা সম্ভব হয় না। ঠিক তেমনিভাবে মহান আল্লাহর সান্নিধ্য পাওয়ার জন্যও প্রয়োজন যথাসাধ্য প্রচেষ্টা। এজন্য মহান আল্লাহ তাঁর বান্দাদেরকে কতিপয় কাজ নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং কেবল তাঁর ইবাদতের আদেশ দিয়েছেন। এর মধ্যে একটি বিশেষ ইবাদত হ’ল রামাযানের ছিয়াম, যা আল্লাহ তাঁর বান্দার উপর ফরয করেছেন। আল্লাহ বলেন,
يَا أَيُّهَا
الَّذِيْنَ آمَنُوْا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى
الَّذِيْنَ مِن قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُوْنَ-
‘হে ঈমানদারগণ! তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হ’ল, যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীগণের উপর ফরয করা হয়েছিল, যাতে তোমরা সংযমশীল হ’তে পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩)।
রামাযানের ছিয়াম আল্লাহর পক্ষ হ’তে তাঁর বান্দাদের জন্য
একটি বিশেষ নে‘মত। আর তা পালনের অফুরন্ত প্রতিদানও মহান আল্লাহর নিকটে
রয়েছে। হাদীছে এসেছে, মহান আল্লাহ বলেন, ‘ছিয়াম স্বতন্ত্র, তা আমারই জন্য।
আর আমিই তার প্রতিদান দিব’।[1] তাই রহমত,
বরকত ও মাগফিরাতে পরিপূর্ণ এ মাসে আমাদের কিছু করণীয় রয়েছে। মাহে রামাযানের
কার্যাবলীকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন- ১. আত্মিক কার্যাবলী ২.
বাহ্যিক কার্যাবলী। নিম্নে এগুলো সম্পর্কে আলোকপাত করা হ’ল-
১. আত্মিক কার্যাবলী :
(ক) আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আকাঙ্খা :
প্রত্যেক ছায়েমের উচিত শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য ছিয়াম পালন
করা। কারণ আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য করা না হ’লে তা কবুল হবে না। রামাযানের
ছিয়াম পালন প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের সাধনা। কেননা এ ইবাদতে
লোক দেখানোর অহেতুক অভিলাষ থাকে না। তাই আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে
ছিয়াম পালন করার মাধ্যমেই বান্দা তার কাঙ্খিত পুরস্কার লাভ করতে পারে।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, مَنْ صَامَ يَوْمًا فِيْ سَبِيْلِ اللهِ بَاعَدَ اللهُ مِنْهُ جَهَنَّمَ مَسِيْرَةَ مِائَةَ عَامٍ– ‘যে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করার জন্য একদিন ছিয়াম পালন করবে, আল্লাহ জাহান্নামকে তার নিকট হ’তে একশত বছরের পথ দূরে সরিয়ে দিবেন’।[2]
(খ) আত্মশুদ্ধি অর্জনের প্রচেষ্টা :
রামাযান মাস হচেছ আত্মশুদ্ধি অর্জনের মাস। সকল পাপাচার-অনাচার দূরে ঠেলে
দিয়ে একনিষ্ঠভাবে আল্লাহর ইবাদত করার মাধ্যমে নেকী অর্জনের মাস। কেননা মাহে
রামযানের মূল আবেদনই হ’ল সর্বোতভাবে আল্লাহমুখী হওয়া। তাই প্রত্যেক
ঈমানদারের অবশ্য কর্তব্য হ’ল এ মাসে আত্মশুদ্ধি ও আল্লাহভীতি অর্জনের
চেষ্টায় লিপ্ত হওয়া। আল্লাহ বলেন, ‘তোমাদের উপর ছিয়াম ফরয করা হয়েছে যেন
তোমরা তাক্বওয়া অর্জন করতে পার’ (বাক্বারাহ ১৮৩)।
২. বাহ্যিক কার্যাবলী :
(ক) নফল ছালাত আদায় : রামাযান মাস
হচ্ছে অধিক নেকী অর্জনের মাস। তাই প্রত্যেক ঈমানদারের উচিত এ মাসে বেশী
বেশী নফল ছালাত আদায় করা এবং পুণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা। কেননা মানবজাতি
শয়তানের ধোঁকায় পড়ে ইবাদতে অত্যন্ত গাফেল থাকে; কিন্তু এ মাসে শয়তান
মানুষকে ধোঁকা দিতে পারে না। কারণ আল্লাহ এ মাসে শয়তানকে শৃংখলাবদ্ধ করে
রাখেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘রামাযানের আগমন ঘটলে জান্নাতের দরজা সমূহ
খুলে দেয়া হয়, জাহান্নামের দরজা সমূহ বন্ধ করে দেয়া হয় এবং শয়তানকে
শৃঙ্খলিত করা হয়’।[3]
তাই প্রত্যেক মুসলিমের জন্য অবশ্যই কর্তব্য এ সুযোগকে
কাজে লাগিয়ে আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য এ মাসে বেশী বেশী নফল ছালাত আদায়
করা ও নিজের জন্য জান্নাতের দ্বার খুলে নেয়া।
(খ) কুরআন তিলাওয়াত করা : পবিত্র
কুরআন হচ্ছে মানব জাতির জন্য আল্লাহর পক্ষ হ’তে শ্রেষ্ঠ উপহার। এটি নাযিল
হয়েছে রামাযান মাসে। ফলে রামাযান মাস বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে। মহান আল্লাহ
বলেন, ‘আমি রামাযান মাসে কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানব জাতির হিদায়াতের জন্য’ (বাক্বারাহ ১৮৫)। তাই কুরআন নাযিলের মাস হিসাবে সকলের উচিত এ মাসে বেশী বেশী কুরআন তেলাওয়াত করা।
(গ) সাহারী খাওয়া : রামাযানে বান্দার অন্যতম কর্তব্য সাহারী খাওয়া। রাসূল (ছাঃ) বলেন, ‘তোমরা সাহারী খাও, কেননা এতে বরকত নিহিত রয়েছে’।[4]
অন্যত্র রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘আমাদের ছিয়াম ও কিতাবধারীদের (ইহুদী ও খৃষ্টানদের) ছিয়ামের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সাহারী খাওয়া’।[5] তাই ছায়েমের জন্য অবশ্য কর্তব্য হ’ল যথাসময়ে সাহারী খাওয়া।
(ঘ) ইফতার করা : ছাওমের একটি বিশেষ
কাজ হচ্ছে সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করা। ইফতারের সময়টি আল্লাহর পক্ষ
হ’তে ছায়েমের জন্য একটি বিশেষ নে‘মত। হাদীছে এসেছে, ছায়েমের জন্য দু’টি
আনন্দময় মুহূর্ত রয়েছে। একটি হ’ল ইফতারের সময়, আর অপরটি হ’ল তার
প্রতিপালকের সাথে সাক্ষাতের সময়’।[6]
(ঙ) তারাবীহর ছালাত আদায় : রামাযান
মাসের চাঁদ ওঠার সাথে সাথেই রামাযানের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। এর মধ্যে যে
কাজটি সর্বপ্রথম পালন করা হয়, তা হচ্ছে তারাবীহর ছালাত। প্রত্যেক ছায়েমের
জন্য তারাবীহর ছালাত আদায় করা কর্তব্য। রাসূল (ছাঃ) তাঁর উম্মতকে তারাবীহর
ছালাত আদায় করার জন্য গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ ‘যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে ও নেকীর আশায় রামাযান মাসে ক্বিয়াম করবে (তারাবীহ পড়বে) তার পূর্বেকার পাপ সমূহ মাফ করে দেয়া হবে’।[7] উলেখ্য যে, রামাযান মাসে তারাবীহ পড়লে তাহাজ্জুদ পড়তে হয় না।
(চ) দান করা : বছরের ১২টি মাসের মধ্যে
সবচেয়ে বরকতময় মাস হচ্ছে রামাযান মাস। এ মাসের প্রত্যেকটি দিন আল্লাহর
নে‘মতে পরিপূর্ণ। তাই আল্লাহর নে‘মতের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ প্রত্যেক ঈমানদারের
উচিত এ মাসে বেশী বেশী দান করা। উম্মতের দিশারী রাসূল (ছাঃ) এ মাসে অত্যধিক
দান করতেন। হাদীছে এসেছে, ইবনে আববাস (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি বলেন,
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) সমস্ত লোকের চেয়ে অধিক দানশীল ছিলেন। আর মাহে রামাযানে
যখন জিবরীল (আঃ) তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন, তখন তিনি আরো বেশী বদান্যতা
প্রদর্শন করতেন। জিবরীল রামাযানের প্রত্যেক রাত্রিতে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ
করতেন এবং তাঁর কাছে কুরআন পুনরাবৃত্তি করতেন। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) জিবরীলের
সঙ্গে সাক্ষাৎ কালে অবশ্যই কল্যাণবহ মুক্ত বায়ু অপেক্ষা অধিক দানশীল ছিলেন।[8]
(ছ) অশ্লীল ভাষা ও মিথ্যাচার হ’তে দূরে থাকা : এ
দু’টি কাজ জঘন্য পাপ, এগুলো মানুষের দুনিয়াবী জীবনে যেমন ক্ষতিকর তেমনি
আখিরাতে আল্লাহর ক্রোধের কারণ। তাই এ আত্মশুদ্ধির মাসে এ ধরনের পাপাচার
হ’তে দূরে থাকার জন্য তাঁর উম্মতকে সতর্ক করে দিয়ে গেছেন। রাসূলুল্লাহ
(ছাঃ) বলেন, ‘যখন তোমাদের কারো ছাওমের দিন হবে সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ
না করে ও হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে ঝগড়া
করে তাহ’লে সে যেন বলে, আমি ছায়েম’।[9]
রামাযান মাসে মিথ্যাচার সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ‘যদি কোন ব্যক্তি
মিথ্যা কথা বলা ও তার উপর আমল করা পরিহার করতে পারল না, তার পানাহার ত্যাগ
করায় আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই’।[10]
(জ) ই‘তিকাফ করা : ই‘তিকাফ হ’ল
রামাযানের শেষ দশদিনে মহান প্রভুকে ডাকার উদ্দেশ্যে কোন মসজিদে অবস্থান
করা। একনিষ্ঠভাবে মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভের অন্যতম মাধ্যম হ’ল ই‘তিকাফ।
রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) ই‘তিকাফ করেছেন এবং তাঁর উম্মতকে তা করার জন্য উৎসাহ
দিয়েছেন। ই‘তিকাফ পুরুষ-মহিলা সবাই করতে পারে। আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত,
নবী করীম (ছাঃ) রামাযানের শেষ দশকে মহান আল্লাহ তাঁকে মৃত্যু দান করা
পর্যন্ত ই‘তিকাফ করেছেন’।[11] উল্লেখ্য যে, ই‘তিকাফ করার জন্য মসজিদ শর্ত।
(ঝ) শেষ দশকে ইবাদতে লিপ্ত থাকা :
আল্লাহ রাববুল আলামীন পবিত্র কুরআন নাযিল করেছেন কদরের রাত্রিতে। আর এ
মর্যাদাপূর্ণ রাত্রিটি মাহে রামাযানে বিদ্যমান। মহান আল্লাহ বলেন, ‘কদরের
রাত্রি সহস্র মাস অপেক্ষা উত্তম’ (কদর ৩)। তাই রাসূল (ছাঃ) এ
কদরের রাত অনুসন্ধান করার জন্য তাঁর উম্মতকে উৎসাহ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন,
রামাযান মাসের শেষ দশকের বেজোড় রাতগুলোতে ক্বদর অনুসন্ধান কর’।[12]
এমনকি রাসূল (ছাঃ) এ রাতগুলোতে অত্যধিক ইবাদত করে কাটাতেন এবং তাঁর
পরিবারবর্গকেও ইবাদত করার জন্য বলতেন। মা আয়েশা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত, তিনি
বলেন, রামাযানের শেষ দশক প্রবেশ করলে আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) স্বয়ং রাত্রি
জাগরণ করতেন এবং পরিবার-পরিজনকেও জাগিয়ে দিতেন। আর ইবাদতের জন্য কোমর বেঁধে
নিতেন’।[13] তাই প্রত্যেক ছিয়াম পালনকারীদের উচিত শবেক্বদর অনুসন্ধান করা এবং রামাযানের শেষ দশকে বেশী বেশী ইবাদত করা।
(ঞ) ফিৎরা প্রদান করা : ছায়েমের জন্য
যে সকল কাজ অবশ্য পালনীয় তার মধ্যে অন্যতম হ’ল ফিৎরা প্রদান করা। এ
প্রসঙ্গে ইবনে ওমর (রাঃ) হ’তে বর্ণিত হাদীছে এসেছে, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)
স্বীয় উম্মতের ক্রীতদাস-স্বাধীন, পুরুষ-নারী, ছোট-বড় সকলের উপর মাথা পিছু
এক ছা‘ খেজুর, যব অথবা খাদ্যবস্ত্ত ফিৎরা হিসাবে ফরয করেছেন’।[14] উল্লেখ্য যে, দেশের প্রধান খাদ্য দিয়ে ফিৎরা প্রদান করতে হয়। এক ছা‘ বর্তমানের হিসাবে আড়াই কেজি চাউলের সমান।
উপসংহার :
মানব জাতি আজ ভুলের মধ্যে নিমজ্জিত। শয়তানের ধোঁকায় পড়ে
তারা আল্লাহর ইবাদতে গাফেল হয়ে গেছে। উদাসীনতায় গা ভাসিয়ে দিয়ে তারা আজ
ধ্বংসের অতল তলে তলিয়ে যাচ্ছে। পাপের কাজ করছে বিরামহীন ভাবে। কিন্তু মহান
আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল। তিনি তাদেরকে অনুতপ্ত হওয়ার সুযোগ দান করেছেন।
তেমনি এক অপূর্ব সুযোগ আসে মাহে রামাযানে। এ মাসেই মানুষ পারে সমস্ত
পাপ-পংকিলতা হ’তে মুক্ত হ’তে। তাইতো কবি বলেছেন,
ছাওম রেখে কর অনুভব
ক্ষুধার কেমন তাপ,
দেহ-মনের সাধনায়
পুড়িয়ে নে তোর পাপ।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সকল অন্যায় অনাচার হ’তে বিরত থেকে মাহে রামাযানের করণীয়গুলো সঠিকভাবে পালন করার তৌফীক দান করুন- আমীন!
– আবিদা নাছরিন
No comments:
Post a Comment